21-02-2015, 08:40 PM
।।ঊনষাট।।
প্রথম শ্রেনীতে প্রথম।খবরটা গুলনারকে টেলিফোনে প্রথম দিল মামুন।আব্বু তার জামাইকে একটা ঘড়ি উপহার দিয়েছেন।রিসিভার ধরে মুখে কথা যোগায় না।ওপার থেকে মামুন বলে,অপা কিছু বলতেছো না,এতবড় একটা খবর দিলাম।
--'বড় খবরের কি আছে?ডাক্তার ইঞ্জিনীয়র হলে না হয়--।'কথাটা অজান্তে ফস করে বেরিয়ে আসে।
মামুন প্রতিবাদ করে,কি বলতেছো অপা,দুলাভাই প্রথম হয়েছে?
--'মায়ে কেমুন আছে?অন্য প্রসঙ্গে চলে যায় গুলনার।
টেলিফোন রেখে টিচার্স রুম ফিরে গালে হাত দিয়ে বসেন।জানলা দিয়ে মনটা বেরিয়ে দূর অতীতে বিচরণ করতে থাকে।গুলনার এম.এ.তে পেয়েছিলেন সেকেণ্ড ক্লাস।আব্বু তাকে দিয়েছিলেন একটা নেকলেস।সরকারী অফিসের পিয়ন সারাদিন পাঁচজনের খিদমদ খাটতো এখন এম.এ.পাস?বিয়ের আগে শর্ত করিয়ে নিয়েছিলেন পড়াশুনা করতে হবে।স্বামীর পরিচয় দিতে এখন আর সঙ্কোচের কারণ থাকলো না। তাহলে কেন গুলনারের মনে এই অস্বস্তি?এর কারণ কি?অবচেতনে কোন ঈর্ষাবোধ কাজ করছে নাতো?শুষ্ক হাসি ফোটে গুলনারের ঠোটে।আহা!যত বোকাবোকা কথা।গুলনারই তো দেবকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন,না হলে কোথায় থাকতো সে?
--বাড়ি থেকে কোন খারাপ খবর?
মিসেস চৌধুরির কথায় সম্বিত ফেরে,ঘাড় তুলে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন গুলনার, না না কুশল বিনিময়।
--টেলিফোন রেখে এমন গম্ভীরভাবে বসলেন আমি ভাবলাম বুঝি--।কথা শেষ না করে চলে গেলেন মিসেস চৌধুরী।
বাড়ি থেকে কোনো খারাপ খবর আসেনি তাহলে মন ভারাক্রান্ত কেন?নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেন গুলনার। আম্মু তার জামাইরে নিয়ে আদিখ্যেতা করবে,উনিও ভাববেন কি না কি করেছেন,কল্পিত নানাছবি তাকে স্বস্তি দিচ্ছে না।কখন ঘণ্টা পড়ল খেয়াল নেই।জুনিয়ার শিক্ষিকা সাহানা ক্লাস থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করে,মণ্টিদি আপনার ক্লাস আছে?
--ঘণ্টা পড়ে গেছে? হ্যা ক্লাস আছে--তুমি কিছু বলবে?
সাহানার মুখ দিয়ে হাসি উপচে পড়ছে,ফিসফিস করে বলে,অধ্যাপিকা আবার বিদেশে চলে যাচ্ছেন।
--ধ্যৎ তোমার যত বাজে কথা।গুলনার ক্লাসে চলে গেলেন।
ক্লাসে ঢুকে টের পেলেন মনটা বিক্ষিপ্ত।সাহানা কি বলছিল?মৌসম চলে যাচ্ছেন?ওর ছোট বোনও এবার পরীক্ষা দিয়েছে।জিজ্ঞেস করা হয়নি রেজাল্ট কি? এত গোলমাল করে মেয়েগুলো?
--এ্যাই কি হচ্ছে কি?
--দিদিমণি,ও বলছে আমরা নাকি বান্দর ছিলাম।
--চুপ করে বোসো।হ্যা, বান্দর ঠিক না তবে বান্দরের মত একটা প্রাণী এপ থেকে মানুষের সৃষ্টি।এটা ডারুইন সাহেবের তত্ব।
একটি মেয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে,গরু-ছাগল থেকে কি হয়েছে?
--চুপ করে বসতে বলেছি,বই খোলো।গুলনার মনে মনে ভাবেন,বলদ এখন মানুষ হয়েছে।
টিচার্স রুমে তখন মুখোরোচক আলোচনা শুরু করে দিয়েছে সাহানা।মিসেসচৌধুরী রায় দিলেন,এ একধরনের যৌণ বিকার।অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মধ্যে এই ধরণের বিকার দেখা যায়।শেক্সপীয়ারও নাকি ছিলেন সমকামী।
-- সমকামিতা নাকি মেয়েদের মধ্যেও আছে?
মিসেস চৌধুরির অবাক লাগে তিনিও শুনেছেন মেয়েতে মেয়েতে সম্পর্কের কথা।অদ্ভুত লাগে ঐ জিনিসটা ছাড়া কিভাবে তৃপ্তি পায়?
--কিরে সাহানা মৌসম না কি নাম তার এখনো মাসিক হয়?
উচ্ছসিত হাসিতে কলকল করে টিচার্স রুম।গুলনারকে ঢুকতে দেখে হাসি থেমে যায়।গুলনার জিজ্ঞেস করেন,সাহানা তোমার বোনের কি খবর?
--পাস করেছে।সাহানা মৃদু স্বরে বলে।
--ওমা ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেছে?রসের আলোচনা হলে সময় কেটে যায় হু-হু করে।
বাসায় ফিরে চা বানায়।দেবের কথা মনে পড়ল।মামুন বলছিল,টিভিতে যেদিন তার অনুষ্ঠান হচ্ছিল গান শুনতে শুনতে দেবের চোখ থেকে পানি পড়তেছিল।গুলনার জানে দেব চোখ বন্ধ করে গান শোনে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ে।সবার গান শুনলেই কি পানি পড়ে নাকি শুধু মণ্টির গান শুনে? মৌসমের গান শুনলেও কি পানী পড়ে?মৌসম কি গান জানে?নিজেকে ধমক দিলেন গুলনার,যত আবোল তাবোল ভাবনা।কি বিকৃত রুচি!ভাবতে অবাক লাগে এরাই শিক্ষা জগতের মাথায় বসে আছেন।তারই বা কি দোষ? একদিন যারা তার উপর অত্যাচার করেছিল কিভাবে দেবকে তার থেকে আলাদা করবে? গুলনারের চোখ ঝাপসা হয়ে এল।জোর করে কাউকে ধরে রাখতে চায় না গুলনার।
ড.জাভেদ শামীম সাহেবের স্বাক্ষর করা নিয়োগপত্র পেয়ে খবরটা আম্মুকে জানিয়েছে বলদেব। আম্মুই জানিয়ে দেবেন সবাইকে।মণ্টি আসেনি গত সপ্তাহে।টিভিতে যেদিন প্রোগ্রাম ছিল সবাই ভেবেছিল মণ্টি আসতে পারে,কিন্তু আসেনি।খুব দরদ দিয়ে গায় মণ্টি।এই সপ্তাহে কি আসবে? মণ্টির সব আশা পুরণ করেছে।পক্ষকালের মধ্যে কলেজের কাজে যোগ দিতে বলেছে।তার আগে কি মণ্টির সঙ্গে দেখা হবে না?মায়ের মুখটা মনে পড়ে।লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল অভাগিনী মহিলা।আজ থাকলে কি খুশিই না হতো।মা বলতো,বলা অতীতের আন্ধারে মুখ গুজে থাকিস না।যার ভবিষ্যত নাই সে অতীতের জাবর কাটে।বেশি লেখাপড়া জানতো না মা,কোথায় শিখলো এইসব কথা?ঈশ্বর হয়তো নিজের কথা মায়ের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছে। কত মানুষকে অলস বসে বসে পুরানো কালের স্মৃতিচারণ করতে দেখেছে।
সমুদ্রের উচ্ছসিত তরঙ্গ বলেদেবের মধ্যে আছড়ে আছড়ে পড়ে।আকাশে এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে মেঘের মধ্যে দিয়ে। বিলেত দেশটা কেমন? মৌসম বলেছে সামনে দুটো অপশন।ভার্সিটিতে রঞ্জনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
--কনগ্রাচুলেশন সোম।
--ধন্যবাদ।তোমার কি খবর বলো?
--মোটামুটি পাস করেছি।
--এবার কি করবে?
--ভাবছি দিদির মত কোন স্কুলে দিদিমণির চাকরি নেবো।সোম এবার তুমি বিয়ে করো।
রঞ্জণার ধারণা বলদেব অবিবাহিত,মজা করে বলে,কে আমাকে বিয়ে করবে?
--আহা জানো না যেন।
বলদেব ইঙ্গিতটা বোঝার চেষ্টা করে।রঞ্জনার কি তার প্রতি দুর্বলতা আছে?ভুল ভেঙ্গে দেওয়া দরকার না হলে কষ্ট পাবে।কথাটা বলে রঞ্জনা অস্বস্তি বোধ করে।তাড়াতাড়ি বলে,সোম এখন আসি।বলদেবের নাম সোম হয়ে গেল মৌসমের জন্য।মৌসম ক্লাসে এই নামে ডাকতেন।বিছানায় শুয়ে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে বলদেব।
চলবে]
আমি ক্লান্ত এক পদাতিক
ঘুরে ঘুরে চারদিক
উকি দিই ঘরে ঘরে
অন্দরে অন্তরে।
ঘুরে ঘুরে চারদিক
উকি দিই ঘরে ঘরে
অন্দরে অন্তরে।